আমার বাবা ঢাকা শহরের একজন রিকশাচালক। প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠেই তিনি জীবিকার সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন।
আবার সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আমার জন্য নিজে হাতে রান্না করেন।রাতে আমি আর আমার বাবা একসাথে বসে খাওয়া-দাওয়া করি।এভাবেই চলে যায় আমাদের দিন।
কয়েক বছর আগে মা আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন পরপারে।কিন্তু বাবা আমাকে মায়ের অভাব কখনো বুঝতে দেননি। দিন এনে দিন খাওয়া এক গরীবের ঘর আমাদের। কখনো কখনো অভাব অনটনের কারণে অনাহারেও থাকতে হয়। আমাদের স্থায়ী কোনো জমি জায়গা নেই।তাই, অনেক কষ্টে বস্তিতে একটি ঘর নিয়ে দুজনে ভাড়া থাকি। বাবা সবসময় চেষ্টা করেন ঘরভাড়া সময় মতো পরিশোধ করতে।কিন্তু হঠাৎ একবার তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় ভাড়া দিতে দেরি হয়ে যায়।
সে সময় একদিন সকালে ঘরের মালিক আসেন ভাড়া নেওয়ার জন্য।বাবা সবকিছু তাকে বুঝিয়ে বলেন এবং হাত জোড় করে আরও কিছু সময় প্রার্থনা করেন।
কিন্তু ঘরের মালিক সব শুনেও কোনো কথা রাখলেন না।বরং বাবাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করলেন।
আর বললেন,
“ভাড়া যদি দিতে না পারো তাহলে ঘরে থাকার কি দরকার? ছেলে নিয়ে রাস্তায় থাকো।”
বাবা কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে রইলেন।তার চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি ঝরে পড়লো। পরের দিন সকালে বাবা অসুস্থ অবস্থায় রিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন।সকালবেলা একজন পেসেঞ্জারও পেয়ে যান।
যখন নির্দিষ্ট গন্তব্যে এসে গেলো, তখন লোকটি বাবার সাথে ভাড়া নিয়ে তর্কাতর্কি শুরু করলো।বাবা আস্তে রিকশা চালিয়েছেন বলে লোকটি ভাড়া কম দিতে চান আর মারমুখী আচরণ করেন। আমি তখন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিলাম।হঠাৎ বাবাকে মার খেতে দেখে তাড়াতাড়ি ছুটে যাই সেখানে। লোকটি এই দেখে একরাশ ঘৃণা নিয়ে বললেন “যেমন বেয়াদব রিকশাওয়ালা, তেমন বেয়াদব তার ছেলে। যত্তসব ছোটলোক।” বাবা সেদিন কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, “তরে লেখাপড়া কইরা অনেক বড়ো হইতে হইবো, বাপ। তাইলে আমাগো দুঃখকষ্ট আর কিচ্ছু থাকবো না।”
বাবার সেদিনের কথা গুলো আমার মনে গেঁথে যায়।তারপর থেকে প্রাণপণ চেষ্টা করে লেখাপড়া করতে থাকি।এরপর কেটে যায় দীর্ঘ এক যুগ। আমার অক্লান্ত পরিশ্রম আর অধ্যবসায়ের কারণে পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।আজ আমার গ্রাজুয়েশন পরীক্ষার রেজাল্ট দেবার কথা। ভার্সিটিতে এসে যখন আমি আমার রেজাল্ট দেখলাম, নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনি। আমি সিজিপিএ 4 নিয়ে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করলাম।
বাবার কথা আমি রাখতে পেরেছি।তাই, আজ বাবাকে জড়িয়ে ধরে জীবনের সব বেদনা ম্লান করে ফেললাম।
আর আজ আমি মাস শেষে মোটা অংকের টাকা বাবার হাতে তুলে দিতে পারি।এখন কোনো কিছুরই অভাব নেই আমাদের।
সময় চিরদিন একরকম থাকে না।চেষ্টা ও অধ্যবসায় দ্বারা আমরা পরিবর্তন করতে পারি আমাদের ভাগ্যকে।
নতুন চাকরির খবর সবার আগে পেতে